নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা:
বীরাঙ্গনাদের কাছ থেকে তাদের ওপর ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথা শুনতে চাইলে বিশ্বাসের দরকার হয়। কেউ একজন সামনে রেকর্ডার ধরলেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে বলবেন এমন নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সাক্ষাৎ করেছেন একাধিক বীরাঙ্গনা মা এবং তাদের যুদ্ধশিশুর সঙ্গে। জেনে এসেছেন পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের সব বর্ণনা। সে সব অভিজ্ঞতা ও বীরাঙ্গনাদের সম্মানের জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া এখন কতটা সম্ভব—এসব নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বিজয় নিউজ বিডি র সঙ্গে।
বিজয় নিউজ বিডি :বীরাঙ্গনা নারীদের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা যদি বলেন…
তুরিন আফরোজ :প্রথম কায়সারের মামলায় সুযোগ হলো, ধর্ষণের শিকার নারীর মুখোমুখি হওয়ার। আমরা খবর পেলাম হবিগঞ্জের মাধবপুর গ্রামে মাজেদা নামের এক বীরাঙ্গনা মায়ের । লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা নারী ছিলেন বলে খুঁজে পেলেন এবং তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে রাজি করানো হলো। তার মুখোমুখি হওয়ার কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি ছিলো তিনি আসলে নিজের কথাগুলো বলতে চান কিনা, বলার মতো শক্তিশালী অবস্থানে ছিলেন কিনা, সেসব দেখা। একবছরের মতো তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আমরা কথা বলার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছিলাম।
মাজেদার একটি যুদ্ধশিশু আছে। তার নাম শামসুন্নাহার । দু’জনের সঙ্গেই এক দেড় বছরের সম্পর্কের ভিত্তিতে আমরা কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছিলাম। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়, বীরাঙ্গনারা দেখা হওয়া মাত্রই তাদের কথা বলতে শুরু করবেন। মাজেদা আকারে ছোটখাটো ভদ্রমহিলা। তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতে হয়েছে। তারপর হয়তো খুব জোর ৫ মিনিট সে সব স্মৃতির কথা তিনি বলেছেন। আমি হয়তো জিজ্ঞেস করলাম, মা একাত্তরে আপনাকে কে ধরে নিয়ে গিয়েছিল…। উনি হয়তো বললেন, এই মাইয়া তুমি মাথায় তেল দেও না কেন? চুলগুলা সব পইড়া যাইতেছে। মানে হলো, উনি আমার এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে আগ্রহী না। তখন আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ করতে হয়েছে। এরপর উনি যখন আমাকে বিশ্বাস করতে পারলেন তারও অনেকদিন পর নিজের কথাগুলো বললেন।
বিজয় নিউজ বিডি : আপনি একাধিক যুদ্ধশিশুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাদের লড়াইয়ের জায়গাটা কী রকমের?
তুরিন আফরোজ :শামসুন্নাহারের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও আমার জন্য বিশাল অভিজ্ঞতার। মেয়েটির জন্ম ১৯৭২ সালে। আমারই বয়সী একটি মেয়ে অথচ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আমি যা যা সুযোগ পেয়েছি, তার সবটা তাকে দিয়ে দিলেও এক জায়গায় তিনি থমকে যাবেন। আমি গর্ববোধ করে বলি আমি অমুকের মেয়ে। কিন্তু, শামসুন্নাহারের আত্মপরিচয়ের এই সংকটের কষ্টটা আমরা কোনওদিনই পূরণ করতে পারব না। তিনি জানেন না তার বাবা কে। কী কষ্টের হতে পারে যখন কিনা ৩৩ বছর বয়সে এসে যুদ্ধশিশু পরিচয় বের হয়ে যাওয়ার কারণে তার সংসার ভেঙে যায়। তার শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তবে তার বাবা আতাই মিয়া যিনি শামসুন্নাহারকে বাবার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনিও শ্রদ্ধার যোগ্য।
এটিএম আজহারের মামলায় মনসুরা নামে একজন বীরাঙ্গনাকে আমরা পেয়েছিলাম। অত্যন্ত সাহসী। তার চেয়েও সাহসী মনসুরা বেগমের স্বামী। তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলেছিলেন, আমার নাম এই, আমার ঠিকানা এই, আমার বাবার নাম এই, মায়ের নাম এই এবং আমার স্ত্রী একজন বীরাঙ্গনা। একজন রিকশাচালক যখন অবিচলভাবে এমন সাক্ষ্য দেন, তখন তাকে সম্মান করতে হয়।
কিশোরগঞ্জে মামলা তদন্ত করতে শহীদ আব্দুল মালেকের বাড়িতে গিয়েছি। সেখানে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে এক নারী বাচ্চাদের নিয়ে উপস্থিত। তিনি আমাদের কাছে তার মায়ের ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাইলেন। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জের নিকলি থানা সদরে তার মা ছিলেন। যুদ্ধের সময় রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাদের হাতে ধরা পড়েন তিনি। এরপর পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা দিনের পর দিন ধর্ষণের শিকার হতে হয় তার মাকে। যুদ্ধ শেষে সেই নারী জন্ম দেন তাকে। এরপর বড় হওয়ার সময় তাকে (অভিযোগকারী) প্রতিবেশীদের নানা রকম কথা শুনতে হয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সইতে হচ্ছে ‘পতিতার মেয়ে’ বলে অপমানজনক ডাক। যুদ্ধের সময় থেকে এভাবেই মা ও মেয়ে দু’জনেই দুঃখ কষ্ট ও বিড়ম্বনার মধ্যে পার করছেন।
যুদ্ধশিশুদের সবাই যে মুখ খুলে কথা বলবেন, তা নয়। চলমান একটি মামলায় আরেক জন বীরাঙ্গনারও যুদ্ধশিশু রয়েছে।১৯৭১ সালে এই বীরাঙ্গনা এক সন্তানসহ বিধবা হন। বিজয়ের পর যুদ্ধশিশুটিসহ দুই সন্তান নিয়ে তিনি এলাকা ছেড়ে ভিন্ন জায়গায় বসবাস শুরু করেন। যুদ্ধশিশুটির বয়স যখন ১৪ বছর, তখন তিনি জানতে পারেন, তিনি একজন যুদ্ধশিশু। তবে, যুদ্ধসন্তানটি চান না, তার মা ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিন। তিনি মনে করেন, ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিলে, তারা সামাজিক জীবন বাধাগ্রস্ত হবে। এদিক থেকে শামসুন্নাহার সাহসী ছিলেন। ক্যামেরা ট্রায়ালে যেতে চেয়েছিলেন না। তিনি বলছিলেন, ‘আমার হারানোর আর কিছুই নেই। কমুনা ক্যান।’
বিজয় নিউজ বিডি : যে বর্ণনা আপনি বীরাঙ্গনাদের কাছ থেকে পেয়েছেন তা থেকে সেসময়ের নির্যাতনের স্পষ্ট সার্বিক কোনও চিত্র পান?
তুরিন আফরোজ : নিশ্চয়। এ জায়গায় আমি হীরামনি সাঁওতালের সঙ্গে আরেকজন ধর্ষণের শিকার নারী বাসন্তীর কথা বলতে চাই। তিনি আমাদের তার ওপর নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। তেলিয়াপাড়া গেস্ট হাউসে তাকে ৫ মাস বন্দি রাখা হয়েছিল। পা শেকলে বাঁধা, হাত শেকলে বেঁধে জানালার সঙ্গে আটকানো। ইনি এমনই একজন বীরাঙ্গনা, যার কথা শুনে কুকড়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বলে চললেন, গোসলের জন্য সাতদিনে একদিন তাকে সুযোগ দেওয়া হতো। ঘরের মধ্যে একটা বিছানা আর একটা পানির কলস, দিনে কেবল একটা শুকনো রুটি। দলবদ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করা হতো। এই নারী শীতের মধ্যে মেঝেতে শুয়ে থাকতেন। এই এক বর্ণনা বলে দেয় কি ধরনের যৌনদাসত্বের শিকার হয়েছিলেন আমাদের মায়েরা।
শেকল পড়া অবস্থায় জানালা দিয়ে চিৎকার করতেন বাসন্তী—এই আশায়, যদি কেউ শুনতে পান। তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে কেউ তাকে ভীষণ ভয় দেখানোর কারণে আমাদের জানান, ছেলের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, আমি কিছু বলতে চাই না।
আরেক ভিকটিম মনসুরা রংপুর টাউন হলে রেপ ভিকটিমদের দেখেছেন। তিনি একার নির্যাতনের সাক্ষ্য দিয়েছেন এমন নয়। তিনি বলেছেন, কিভাবে মেয়েদের শরীরের নানা অঙ্গে এসিড ঢেলে সেটা বিচ্ছিন্ন করে ইঁদারায় ফেলে দেওয়া হতো। আমরা এসব বিবরণ শুনেছি, এসব বিবরণ তাদের দিয়ে এমনভাবে বলিয়ে নিয়েছি, যেন তাদের সম্মানবোধে আঘাত না আসে। ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে দ্বিতীয়বার যেন তাদের আঘাত করা না হয়।
বিজয় নিউজ বিডি : মামলার তদন্ত করতে গিয়ে বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে আপনার। বিচারের যে জায়গায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে, সেখানে তাদের কথা কতটুকু তুলে আনা সম্ভব হয়েছে?
তুরিন আফরোজ : বীরাঙ্গনার ইস্যুটি আমাদের জন্য স্পর্শকাতর। মামলা করতে গিয়ে নারী প্রসিকিউটর হিসেবে আমার ভিন্ন আবেগের জায়গা তৈরি করে। প্রসিকিউশনে জয়েন করার পর আমি লক্ষ্য করি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মাইন্ডসেট কাজ করছে। ধর্ষণ চার্জকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। যেমন সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর যে ঘটনা সেটার ভিতরে গণহত্যা যেমন আছে ধর্ষণও আছে কিন্তু গণহত্যাকে তুলনামূলক বড় অপরাধ ধরে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগটাকে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। অথচ যারা সাক্ষ্য দিলেন, তাদের তিনজনই ধর্ষণের শিকার। তারা সাক্ষ্য দিলেন ধর্ষণের। তবে চার্জে না থাকার কারণে বিষয়টি পিছনে থেকে গেল।
বিজয় নিউজ বিডি : এই যে এখন বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়া হচ্ছে। এতে তাদের হয়রানি বাড়বে বলে মনে করেন?
তুরিন আফরোজ : বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা বলার যে জায়গাটি, সেটা নৈতিকতার জায়গা থেকে ঠিক আছে। তবে কাউকে জোর করা উচিত হবে না। কেউ যদি মনে করেন, আমি এসবে যেতে চাই না, তাহলে সেটাকে সম্মান করা উচিত। শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের কোনও কাজে তার কষ্ট যেন না বাড়ে। পুনর্বাসন করার যে উদ্যোগ ৭১ থেকে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে কিন্তু পরিচয় গোপন রাখতে অনেক ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো। একটা রেজিস্ট্রার খাতায় হয়তো লেখা হতো আসল নাম কিন্তু আরেকটা রেজিস্ট্রার খাতা যেটা সামনে থাকবে সেখানে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হতো। তাকে ওই নামেই সবাই চিনতেন। এখন যদি বীরাঙ্গনাদের ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা দিতে চায় সেটাও পরিচয় গোপন রেখে করা সম্ভব।